বাঙালির মহালয়া
আশ্বিন
মাসের কৃষ্ণ পক্ষকাল কে বলা হয়
পিতৃ পক্ষ। সনাতন
ধর্মের, মার্কন্ড পুরাণ অনুসারে এই সময় কালে পিতৃ
তর্পণ করার কথা উল্লেখ
আছে। পিতৃ তর্পণ অর্থাৎ পূর্ব পুরুষদের
প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাদের আত্মার তৃপ্ত কামনায় তিল-জল দান। অনেকেই এই সময়ে
অন্ন ও বস্ত্র দানও করে থাকেন। এই পিতৃ পক্ষের শেষ দিনটি হল মহালয়া। প্রকৃতপক্ষে মহালয়ার
সাথে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, দুর্গা পুজোর কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। আসলে মহালয়া হল
একটি তিথি যা হল পিতৃ পক্ষ ও দেবী পক্ষের সন্ধিক্ষণ। তবে বাঙালির মনে এই দুই তিথির সংযোগের যে বীজ রোপন করেছিলেন তাঁর নাম স্বর্গীয়
শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম অনেকেই আমরা না জানলেও বা তার
জীবন ও কর্মের বিশেষ আলোচনা না হলেও আমরা জানি এক কন্ঠস্বর। কন্ঠস্বর যা প্রতি বছর
আপামর বাঙালির মনে সূচনা দেয় মাতৃ আগমনের।
শরতের কাক ভোর,
৪টে বাজতে না বাজতেই বাংলার ঘোরে ঘোরে বেজে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠস্বর। শিশির
ভেজা বাতাসে শব্দ বয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দেয় দূর দূরান্তে। ঘুম ভাঙে মঙ্গল শঙ্খ-ধ্বনি, আগমনীর
সুর ও চন্ডী পাঠে। শুরু হয়ে গেলো দেবী পক্ষ। রেডিওতে "মহিষাসুরমর্দিনী" অনুষ্ঠান
শুনেই যেনো আগমনী সুরের ছোয়া লাগে বাঙালির মনে প্রাণে।
সেই
সময়ে বই ছিল,
কাগজ
ছিল-
পত্রিকা ছিল;
গান শোনার
জন্য গ্রামোফোন ছিল আর ছিল
রেডিও। ওই সময়ে রেডিও
তে যারা ধারা-
বিবরণী
করতেন তাদের মধ্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অন্যতম। ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির (IBC) ক্যালকাটা
ডিভিশন এর ছিল দুটো ভাগ, একটা ইন্ডিয়ান আর একটা ইউরোপিয়ান। ইউরোপিয়ান বিভাগের দায়িত্বে
ছিলেন ওয়ালিক নামে এক ভদ্রলোকের। আর ভারতীয় বিভাগ টি দেখতেন নিপেন্দ্রনাথ মজুমদার।
হঠাৎ একদিন আড্ডা চলাকালীন বেতার জগতের সম্পাদক প্রেমাঙ্কু মশাই প্রস্তাব দিলেন যে
এক নতুন অনুষ্ঠান করা হবে। সকালের দিকে হবে, শ্লোক থাকবে গানের থাকবে এবং বীরেন্দ্র
বাবু তা উপস্থাপন করবে। প্রস্তাবটা মনে ধরলো সকোলের। সম্মতির সিল-মোহর লাগলেন নিপেন্দ্রনাথ। আর এক মাস পর ছিল দুর্গা পুজো।
তাই মার্কন্ড পুরাণ ঘেঁটে, মাতৃ বন্দনায় শ্লোক লিখলেন বাণী কুমার। স্তোত্র পাঠ করবেন
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও সঙ্গীত এ সুর দেবেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক।যাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ছিলেন কায়েস্ত। অব্রাহ্মণের মুখে চন্ডী পাঠ হবে জেনে বেঁকে বসলেন কিছু মানুষ। তবে
নিপেন্দ্রনাথ ও পঙ্কজ বাবুর দৃঢ়তার কাছে হার মেনে প্রথমে বারের মত ১৯৩২ সালে সম্প্রচারিত
হল এই অনুষ্ঠান। নাম দেওয়া হল "প্রত্যুশ প্রোগ্রাম".। পরের বছর এর নাম পরিবর্তন
করে রাখা হল, "প্রভাতি অনুষ্ঠান"। ১৯৩৬ সাল আবার এই অনুষ্ঠানঢির নাম পরিবর্তন
করে রাখা হল "মহিষাসুর বধ"। ১৯৩৭ শে শেষ বারের মতো নাম পরিবর্তিত করে রাখা
হল "মহিষাসুরমর্দিনী"।
মহালয়ার ভোরে
স্টুডিওতে আসার আগে গঙ্গা স্নান করে আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। পরণে থাকতো নতুন থানার ধুতি,
উর্ধাঙ্গ অনাবৃত্তি। ব্রহ্মা মুহূর্তে মায়ের ধ্যান সেরে বসতেন চন্ডী পাঠে। পাঠ যতো
এগোতে থাকে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেনো বাজ্য জ্ঞান রোহিত। মাকে ডাকতে ডাকতে যেনো তিনি আত্মভোলা।
গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শরতের শিশিরের মত পবিত্র অশ্রুকনা। আপামর বাঙালির হৃদয় থমকে যায়
উদাত্ত মা ডাক শুনে ।
তবে অনেক
সময় দেখা যায় আমরা
যে জিনিষ টাকে ভালোবাসি তাকে
আরো আধুনিক করে তোলার জন্য
অহেতুক তার বলি দেই।
আর এটাই করেছিলো আকাশবাণী। সাল ১৯৭৬,
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্রকে সম্পূর্ন গোপনে রেখে ঠিক করা
হল সেবার প্রভাতি অনুষ্ঠান বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জায়গায় করানো হবে উত্তম কুমার
কে দিয়ে। নতুন অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট
লিখলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত এর অধ্যাপক,
ডঃ
গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় ও সুর দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
এবং শৈলেন মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয়েছিলো, "দেবীং দুর্গতিহারিণীম্"।
নির্দিষ্ট দিনে সম্প্রচারিত করা হল আর ফলাফল চূড়ান্ত flop। সেই কলের সমস্ত গুণী শিল্পিরা
থাকা সত্ত্বেও বাঙালির মনে জাগিয়ে করতে পারেনি সেই অনুষ্ঠান। চললো বেতার অফিসে ভাঙচুর,
বস্তা বস্তা এলো অভিযোগ পত্র। তবে এই সবে দোষ ছিল না উত্তম কুমারের। আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের
হীরকে নাজেহাল হয়ে উত্তম বাবু রাজি হয়েছিলেন। এমনকি স্টুডিও তে রেকর্ডিং করার আগে
উত্তম কুমার, বীরেন্দ্র বাবুর কাছে গিয়ে তার অস্বস্তিতার ও অযোগ্যতার কথা জানিয়েছিলেন।
আত্মাভিমানী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র উত্তম কুমার কে উৎসাহিত করেছিলেন। বলেছিলেন সব ঠিক
হয়ে যাবে। সে বছর মানুষের চাপে পড়ে মহাষষ্ঠীর দিন আকাশবাণীকে আরো একবার "মহিষাসুরমর্দিনী"
সম্প্রচারিত করতে হয়েছিলো, তবে এবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায়।
আজও
"আশ্বিনের শারদপ্রাতে" মহালয়ার পুণ্য লগ্নে বাঙালির ঘুম ভাঙে স্বর্গীয়
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র পাঠ শুনে । যেনো কর্মব্যস্ত চঞ্চল
হৃদয়ে জানান দিয়ে যায়, মা আসছেন
।